সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে সভাপতি পদে দায়িত্ব পেয়েছেন চেয়ারম্যান কবির হোসেন মিলন। দুর্নীতির আখড়া সাতক্ষীরা সিটি কলেজের এডহক কমিটির সভাপতি হয়েছেন আগরদাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির হোসেন মিলন। এরআগে সাবেক এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবির সাবেক পিএ মকসুমুল হাকিম কলেজটির এডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই পুনরায় তাকে সভাপতি করার জন্য দুর্নীতিবাজদের একটি চক্র প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন।
এদিকে গত ১৬ জানুয়ারী নতুন সভাপতি হিসেবে কবির হোসেন মিলন মনোনীত হওয়ার সাথে সাথে শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে চাপা আনন্দ বিরাজ করছে। অপরদিকে কলেজটির বর্তমান অধ্যক্ষ ড. শিহাব উদ্দীন নতুন সভাপতি মনোনয়নের চিঠি পেয়েই কলেজ ত্যাগ করেন। তিনি নতুন সভাপতিকে পরিবর্তনে হাইকোটে রীট পিটিশন দায়েরসহ তদবিরে ঢাকায় গেছেন বলে শিক্ষকদের সূত্রে জানান গেছে।
এদিকে এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান মিলন সভাপতি মনোনীত হওয়ায় দুর্নীতিবাজ চক্রটি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। গত ডিসেম্বর ২০২৩ ইং মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় সাতক্ষীরা সিটি কলেজের দুর্নীতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি সভাপতি হওয়ার পর মাত্র তিন বছরে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে প্রায় ৫ কোটি টাকা লোপাট হয়। এব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন চার বছর ধামাচাপা পড়ে রয়েছে। আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও উপেক্ষিত রয়েছে বছরের পর বছর। উল্লেখ্য, সাবেক এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি এবং তার সাবেক পিএ মকসুমুল হাকিম গত ২০১৪ সাল থেকে পর্যায়েক্রমে কলেজটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেক্ষেত্রে মাত্র ৩ বছরের নীরিক্ষা প্রতিবেদনে তাদের বিরুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমান পাওয়া যায়।
এলাকাবাসীরা জানায়, নানা কারণে আলোচিত ছিল ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত সাতক্ষীরা সিটি কলেজ। কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় নতুন সভাপতি চেয়ারম্যান কবির হোসেন মিলনের নানা আব্দুল আজিজ সরদারের ১৬ কাঠা জমিসহ তার স্বজনরাই সমুদয় জমি প্রদান করেন। চেয়ারম্যান কবির হোসেন মিলনের বাবা কাশেমপুর প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নুরুল ইসলাম সরদার স্কুলের চাকরি ছেড়ে নবপ্রতিষ্ঠিত কলেজটির অফিস সহকারীর চাকরি নেন। ২০০৮ সালে চাকরিরত অবস্থায় তিনি মারা গেলে তার ছেলে সমাজ বিজ্ঞানে এমএ পাশ কবির হোসেন মিলনকে মাষ্টাররোলে কলেজের অফিস সহকারীর চাকরি দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে উক্ত পদে কবির হোসেন মিলনের এমপিভুক্তির সুযোগ হয়। কিন্তু সে সময় কলেজের সভাপতি সাবেক এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ও অধ্যক্ষ আবু সাইদ তার পরিবর্তে জনৈক হারুণ অর রশিদকে অফিস সহকারী পদে এমপিওভুক্ত করান। অভিযোগ আছে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে কবির হোসেন মিলনের পদটি মোঃ হারুণ অর রশিদের নিকট বেঁচে দেওয়া হয়। এনিয়ে দীর্ঘ দিন আদালতে মামলা ছিল।
এদিকে কলেজের এমপিও থেকে বঞ্চিত হয়ে ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে কবির হোসেন মিলন আগরদাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি বিএনপি জামায়াত ও আওয়ামী লীগের নেতাদের পরাজিত করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। কলেজ কর্তৃপক্ষ ঐ মাস থেকেই তার মাষ্টাররোলের চাকুরীর বেতনও বন্ধ করে দেন। সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে তিনি কলেজের মাষ্টাররোলের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
এব্যাপারে নব মনোনীত সভাপতি চেয়ারম্যান কবির হোসেন মিলনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন আমার নানাসহ আত্মীয় স্বজনদের জমিতেই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত। আমার পিতার মৃত্যুর পর কলেজের স্বার্থেই এলাকাবাসীর অনুরোধে সমাজ বিজ্ঞানে এমএ পাশ করেও মাষ্টাররোলে অফিস সহকারীর চাকরি নিয়েছিলাম। কিন্তু এমপিওভুক্তির সময় আমাকে বঞ্চিত করা হয়। ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ঐ মাস থেকে কলেজ থেকে আমার বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আমি ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও কোন ভাতা গ্রহণ করিনা। আমার ভাতার সমুদয় টাকা প্রতিমাসেই ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নে পরিষদের তহবিলে জমা দেই।
কলেজের কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দুর্নীতির সাথে জড়িত অধ্যক্ষ এবং তার অনুসারী ৩/৪ জন শিক্ষক কর্মচারী ছাড়া সবাই খুশী। তারা বলেন, আমাদের বেতনের কলেজ অংশ গত ৫/৬ বছর ধরে দেওয়া বন্ধ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করা সম্পর্কে তারা বলেন, যদি বর্তমান অধ্যক্ষসহ সাবেক সভাপতি আবার ফিরে আসে সেক্ষেত্রে আমরা এখানে আর চাকুরী করতে পারবো না। তারা আরো বলেন, চেয়ারম্যান মিলন কলেজের শিক্ষক কর্মচারীদের কাছে একজন সৎ মানুষ হিসেবে পরিচিত। এলাকায়ও তিনি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। ফলে অতিতের মত পেশি শক্তি দিয়ে কেউ তাকে হটাতে পারবে না। এজন্য অধ্যক্ষ ড. শিহাব উদ্দীন সভাপতি হিসেবে কবির হোসেন মিলন দায়িত্ব নিচ্ছেন এমন খবর পাওয়ার পর থেকেই সাংবাদিকদের ডেকে এনে তার সম্পর্কে উল্টাপাল্টা প্রচারণা শুরু করেন। তারা আরো বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় নতুন সভাপতি কলেজে আসবেন এবং সাংবাদিক সম্মেলন করবেন। তখন আরো বিস্তারিত আপনারা জানতে পারবেন। তবে কলেজটি ধ্বংশের হাত থেকে বাঁচাতে এই মূহুর্তে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য আশরাফুজ্জামান আশু, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বর্ষিয়ান জননেতা মোঃ নজরুল ইসলাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরসহ সংশ্লিষ্ঠ সকলকে ধন্যবাদ জানান।
এব্যাপারে সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য আশরাফুজ্জামান আশুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, একজন সিকিউরিটি গার্ড যদি পার্লামেন্ট সদস্য হতে পারেন তাহলে প্রথম শ্রেণির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কেন কলেজের সভাপতি হতে পারবেন না। তিনি বলেন, কয়েকজন সাংবাদিক আমাকে টেলিফোন করে আমি একজন পিয়নকে কলেজের সভাপতি বানিয়েছি কেন এমন প্রশ্ন করে আমার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছেন। আমি স্পষ্ঠভাবে বলছি এতদিন যেভাবে সাতক্ষীরা চলেছে জননেত্রী শেখ হাসিনা সেভাবে চালানোর জন্য নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করে আমাকে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেননি। আমার প্রয়াত নেতা হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আদর্শ এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো। চলমান পরিস্থিতি পাল্টানোর জন্য আমি জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতৃবৃন্দ এবং আমার দলের নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা করেই সববিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। কলেজে সভাপতি নিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা, পার্শ্ববর্তী এলাকার বেশকয়েকজন জনপ্রতিনিধি, কলেজটির অধিকাংশ শিক্ষক কর্মচারী এবং এলাকাবাসীর অনুরোধে কবির হোসেন মিলনের পক্ষে আমি সুপারিশ করেছি।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মশিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় নতুন এমপির সুপারিশে কবির হোসেন মিলনকে সভাপতি করা হয়েছে। সাতক্ষীরা সিটি কলেজের দুর্নীতির বিষয় আমি জেনেছি, এবিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।